দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রথম সারিতে রয়েছে ল্যাবএইড গ্রুপ। সারা দেশে ৩৩টি রোগ নির্ণয় কেন্দ্র ও কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে এ গ্রুপের। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ক্যান্সার চিকিৎসায় পরিপূর্ণ বিশেষায়িত হাসপাতালও রয়েছে। দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা, ব্যবস্থাপনা ও সীমবাদ্ধতা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের চেয়ারম্যান ডা. এ এম শামীম
বাংলাদেশে যে কয়েকটি অসংক্রামক রোগ রয়েছে তার মধ্যে ক্যান্সারের অবস্থান দ্বিতীয়। অসংক্রামক এ রোগ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।
আমাদের একটি পরিসংখ্যান আছে। এখন প্রতি বছর তিন লাখ ক্যান্সার রোগী আসে। দুই দশক আগে ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস (রোগ নির্ণয়) হতো না। হয়তো কেউ পেটে ব্যথা নিয়ে মারা যেত। এখন এমন হলে পরীক্ষা করলে দেখা যায় কিডনিতে টিউমার আছে। কারো মাথাব্যথা থাকলে হয়তো তিন-চার মাস ভুগে মারা যেত। এখন মাথা ব্যথা থাকলে সিটি স্ক্যান হয়, তখন টিউমার ধরা পড়ে। তাই আমি বলব ডায়াগনোসিসই বেশি সহায়তা করছে। আরো একটি বিষয় হলো স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের গড় আয়ু ছিল অনেক কম। সেখানে বর্তমানে গড় আয়ু ৭৩-৭৫। এখন আমাদের ডায়াগনোসিস হচ্ছে, চিকিৎসা হচ্ছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ক্যান্সার যে হঠাৎ করেই বেড়েছে তা আমি বলব না। জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষিত খাবারও ক্যান্সারের কারণ। তবে এ বিষয়গুলো আমাদের যত না ক্ষতি করে তার চেয়ে বেশি বাড়িয়ে বলা হয়।
বাংলাদেশে গড়ে বছরে এক লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে মারা যায়। তবে এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার কি বেশি বলে মনে করেন?
আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন না। যখন ক্যান্সার তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে চলে যায় তখনই মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায়। সে সময় রোগীকে বাঁচানোর আর পথ থাকে না। তাই দেখা যায় রোগী তিন থেকে ছয় মাস বাঁচে। ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। এছাড়া আমরা যদি প্রতিকার থেকে প্রতিরোধের ওপর বেশি জোর দিই তাহলে ভালো হবে। বিদেশে দেখা যায় কারো নিকটআত্মীয়ের এক-দুজন ক্যান্সারে মারা গেলে তিনি জেনেটিক রিপোর্ট মেনে চলেন। ধূমপান কমিয়ে দেয়া, অ্যালকোহল কম পান করা। যদিও আমাদের দেশে মানুষ অ্যালকোহল অনেক কম পান করে। সেই সঙ্গে আঁশযুক্ত বা ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া। এতে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে মেয়েদের ১৮-২০ বছরের মধ্যে চেকআপ করা ও ৩৫ বছরের পর একটি মেমোগ্রাফি করা প্রয়োজন। এছাড়া জরায়ু ক্যান্সার থার্ড স্টেজ পর্যন্ত চিকিৎসা করলে সুস্থ হওয়া যায়। প্রতিরোধের কথা বেশি বেশি বলার এখনো সময় রয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, বছরে তিন লাখ মানুষের নতুন করে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। শনাক্তের বাইরেও অনেক রোগী থেকে যায় যা তিন লাখ হতে পারে, পাঁচ লাখ হতে পারে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
শনাক্তের বাইরেও থেকে যাওয়ার কারণ আমাদের দেশে এখনো ৪০ শতাংশ মানুষ হেলথ কেয়ারের আওতায় আসেনি। এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন তাদের পুরো জীবনে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যায় না। লোকাল হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যায়, তন্ত্র-মন্ত্র করে, ফলে রোগী মারা যায়। এভাবে যদি তিন লাখ শনাক্তের বাইরে থাকে বা এক লাখ মানুষ মারা যায় তাহলে সমপরিমাণ ডায়াগনোসিসের আর সুযোগ থাকে না।
বাংলাদেশের সরকারি বা বেসরকারি সেবার পরিসর গ্রাম-শহর সব জায়গায় বেড়েছে। তার পরও যে ৪০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসাসেবা নেয় না এর প্রধান কারণ কী?
গ্রামে গ্রাম্য ডাক্তারের সংখ্যা বেশি। যদি কারো পেটে ব্যথা হয় তাহলে তাকে হয়তো জিরা পানি খাওয়াবে। এ ধরনের জিনিসগুলো থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। বড় পরিসরে ক্যাম্পেইনিং প্রয়োজন। কোন ধরনের সমস্যাগুলো হলে অন্তত একজন এমবিবিএস ডাক্তাদের কাছে যাওয়া উচিত, সেটা মানুষকে জানাতে হবে। ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষায়িত হাসপাতাল যেমন সরকারি হাসপাতাল তো আছেই সেই সঙ্গে সরকারি কিছু মেডিকেল কলেজেও ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা রেখেছে।
বেসরকারি খাতে ক্যান্সারের চিকিৎসাসেবা অতটা বাড়েনি বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ক্যান্সার একটি সমন্বিত চিকিৎসা প্রক্রিয়া। এর জন্য বড় পরিসরে বিনিয়োগ ও জনবলের প্রয়োজন। যেমন আমরা বলে থাকি, একটি টিউমার বোর্ড না থাকলে কখনই ক্যান্সার ডায়াগনোসিস সম্ভব নয়। টিউমার বোর্ডে থাকবেন যে চিকিৎসক প্রথমে রোগীকে দেখেছেন, একজন সার্জন, একজন রেডিওলজিস্ট, একজন প্যাথলজিস্ট থাকবেন। অবশ্যই এদের থাকতে হবে। আমাদের দেশে বিষয়টি কঠিন। প্রথম যখন রোগী একজন ডাক্তারের কাছে যায় তখন কিন্তু রোগী আটকে যায়। একটি ক্যান্সারের বোর্ড থাকাটি খুবই জরুরি। ক্যান্সার হাসপাতালে দরকার হয় লিনাক্স মেশিন, যার দাম ৩০-৪০ কোটি টাকা; একটি পিইটি স্ক্যানার, যার দাম ১৫-২০ কোটি টাকা। তাই সব মিলিয়ে একটি বেসরকারি ক্যান্সার হাসপাতাল করা কঠিন। কারণ বেসরকারি মানেই ব্যাংকের ঋণ থাকবে, এগুলো আবার ফেরত দিতে হবে। এগুলো অর্থনৈতিকভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে যদি আমরা নির্দিষ্ট করে বলি সরকারি বা বেসরকারি সব খাতেই দক্ষ লোকবলের সংকট রয়েছে। কয়েক দশক ধরেই আছে। আশি বা নব্বই দশকের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা কি এখন বলতে পারি আমাদের পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ লোকবল, চিকিৎসক রয়েছেন?
১৯৮০-এর সঙ্গে তুলনা করলে এখন ১০ গুণ আছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত বলব না। করোনার আগে কার্ডিওলজি চিকিৎসা শুধু জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হতো। এখন বারডেম, ইউনাইটেড এ রকম ১০টি হাসপাতালে হচ্ছে। এখন রাজশাহী, চট্টগ্রাম এসব শহরেও এনজিওগ্রাম বসে গেছে। কার্ডিওলজি নিয়ে বলি তাহলে এখন আমাদের ৫০ শতাংশ সুযোগ-সুবিধা আছে। ক্যান্সারে চিকিৎসা এখন ১০ শতাংশ বেড়েছে, যেটি ১৯৮০ মাত্র ১ শতাংশ ছিল। আমাদের ডাক্তাররা এখন দেশের বাইরে যান। বিভিন্ন সেমিনার, ট্রেনিং করেন। তারা দেখে শিখছেন এবং তাদের ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু আমাদের ল্যাবেএইড ক্যান্সার হাসপাতালটি করা। আমরা ভালো দক্ষ জনশক্তি পেয়েছি।
ক্যান্সারের রেডিওলজির টেকনোলজিস্ট কম। এর কারণ হিসেবে কি দেখছেন?
ধরুন ১০ বছর আগে একজন রেডিয়েশন টেকনোলজিস্ট এল। তার সঙ্গে অপারেট করবে এমন একজন ফিজিসিস্ট লাগবে। ধরুন দেশে মেশিন আছে পাঁচটি। তার মানে পাঁচজন ফিজিসিস্ট লাগবে, তাহলে ৫০০ জন কেন পাস করবে। এখন বেসরকারি অনেক সেক্টর চলে এসেছে, সরকারিও আছে। এখন আমরা রেডিওলজি টেকনিশিয়ানদের জন্য কোর্স খুলছি। ফলে এভাবেই এগিয়ে যাবে। যেখানে কর্মক্ষেত্র সেখানেই মানুষ তৈরি হয়।
বিদেশে চিকিৎসার জন্য আগে মানুষ কার্ডিওলজি বা কিডনি চিকিৎসায় বেশি যেত। এখন মানুষ ক্যান্সার চিকিৎসা নিতে বেশি যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা এতে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি কীভাবে ঠেকানো যায়?
প্রথম কারণ হচ্ছে বিশ্বস্ততা। আমরা যখন ২০০৩ সালে কার্ডিওলজি হাসপাতাল করি তখন এত মানুষ আসত না। এখন আমার নিজের এনজিওগ্রাম এখানে করেছি। সিঙ্গাপুর যেতে পারতাম, যাইনি। আমার এখানেই থেলিয়াম টেস্ট করেছি। এটি তুর্কিয়ে গিয়ে করার কথা ছিল, যেখানে আড়াই হাজার ডলার লাগে। আমার এখানে ১৫ হাজার টাকা লেগেছে। পুরোপুরি ক্যান্সার চিকিৎসা এই মাত্র শুরু হলো ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালের মধ্য দিয়ে। ২০২৪-এ এসে আমরা বলতে পারছি কার্ডিয়াক হাসপাতালকে মানুষ বিশ্বাস করে। এটি শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। একইভাবে আমি বলব দশ বছর পরে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালে মানুষ আসবে।
বাংলাদেশে উৎপাতি ওষুধ স্থানীয় চাহিদা ৯৮ শতাংশ পূরণ করছে। কিন্তু কিছু ওষুধ যেমন ক্যান্সারের ওষুধ এখনো আমদানি করতে হয়। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য দেশীয় ওষুধ কত শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে?
ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রায় ৭৫ শতাংশ ওষুধের চাহিদা পূরণ করে স্থানীয় ওষুধ। ২৫ শতাংশ আমাদের আনতে হয়। এর মধ্যে কিছু হলো ভারত থেকে অবৈধ পথে অনিরাপদভাবে আসে। যেগুলো আমাদের ব্যবহার করা উচিত নয়। ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ গর্ব করে। আমাদের ওষুধের মান ভালো।
তৃণমূলের চিকিৎসা নিয়ে যদি বলি, আমাদের বিভাগীয় পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা অনেক বিস্তৃত হয়েছে। জেলা পর্যায়েও আছে, তবে উপজেলা পর্যায়ের উন্নতি তেমন হয়নি। বিশেষয়িত চিকিৎসাসেবা উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যেতে করণীয় কী?
স্পোক মডেল নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে উপজেলাগুলোয়। আমরা সেভাবে রোগীদের দেখে বাছাই করে নিয়ে আসতে পারব। রোগীর জন্য সার্জারি বা রেডিয়েশন প্রয়োজন হলে আমরা তাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম নিয়ে আসতে পারব। এটি সম্ভব। ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল এটি করছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) হলে এগুলো সম্ভব বলে আমি মনে করি। ভারতের অনেকগুলো দিক আছে যেগুলো দেখে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। বিশেষ করে ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে। আমাদের এই বিষয়গুলো এখনো সাক্ষাৎকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এগিয়ে আসেননি। আমাদের প্রাইভেট হেলথ কেয়ার ৬০-৬৫ শতাংশ সার্ভিস দিচ্ছে। তাই আমি বলব পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ হোক।\
সরকারের বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পরিপূর্ণ সুবিধা নিশ্চিত করাই কঠিন। সেখানে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ হলে সরকার কীভাবে পর্যবেক্ষণ করবে?
সেগুলো করবে প্রাইভেট সেক্টর। আমাদের পিইটি স্ক্যান মেশিন দিয়ে প্রতিদিন ২০টি স্ক্যান করতে পারি, মাসে ৩০০ করতে পারব। আমরা মাসে করি ১২৫টি। আমরা ৪০ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। সরকার যদি আমাদের বলে ১৮০টা করে দিয়ো, ২৫ হাজার টাকা দেব। এখানে আলাদা করে কোনো ম্যানেজমেন্টের দরকার নেই। অনেকে বলবে সরকার এটি ফ্রি করে দেয়। আসলে এখানে সরকারের খরচ হয় ৭০ হাজার টাকা।
আমাদের দেশে ক্যান্সার স্কিনিং ব্যবস্থা কেমন দেখছেন?
দেশে ক্যান্সারের স্কিনিং নিয়ে জোরালো কিছুই হয়নি। এটি একটি আলাদা প্রজেক্ট হওয়া উচিত। ক্যাম্পেইনিং হওয়া উচিত। সরকারি-বেসরকারি দুইভাবেই হওয়া প্রয়োজন, যেটি ভারতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিরোধের জন্য আমাদের স্কিনিং আবশ্যক।
বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা শুরু হচ্ছে সেখানে চিকিৎসা ব্যয় কেমন হতে পারে?
বেসরকারি চিকিৎসায় ব্যয় করতেই হবে। কিন্তু আপনি যদি অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করেন তাহলে আপনি দেখবেন আমাদের দেশে অনেকটাই খরচ কম।
সরকারি উদ্যোগে ক্যান্সার প্রতিরোধ-প্রতিকারের বিষয়ে অনেক কর্মসূচি হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগে এমন কোনো কর্মসূচি নেই তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছার জন্য। কেন?
এটি আমরা স্বীকার করি। আমরা পরিকল্পনা করছি কিছু সোস্যাল ক্যাম্পেইনিং নিয়ে—ধূমপান করবেন না, বছরে একবার রক্ত পরীক্ষা করতে হবে—এসব বিষয় নিয়ে। এটি চলতেই থাকবে। আমরা স্কিনিং নিয়ে ভাবছি। এটি করতে পারলে মানুষের খরচ অনেক কমে যাবে এবং সময় বাঁচবে।