বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কার্ডিয়াক চিকিৎসায় প্রথম দিককার হাসপাতাল ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল। শুরু থেকে এ হাসপাতাল হৃদরোগ চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেবার মান ও প্রসারও বেড়েছে। দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা, ব্যবস্থাপনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম
কার্ডিয়াক চিকিৎসায় দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল অন্যতম। এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের শুরুর দিককার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনার যাত্রা শুরু হয় আশির দশকে। তখন রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০০ সালের পরই মূলত করপোরেট হাসপাতাল বা পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালগুলো কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বেশকিছু করপোরেট হাসপাতাল হয়ে গেছে। এসব হাসপাতালে মানসম্পন্ন চিকিৎসা হয়। পাশাপাশি এগুলোয় রাত্রিকালীন বা ইমার্জেন্সি চিকিৎসাসেবাও দেয়া হয়ে থাকে। দেশে বেসরকারি পর্যায়ে হৃদরোগ চিকিৎসাসেবা যারা দিয়েছে তাদের মধ্যে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল অন্যতম।
এ দেশে কার্ডিয়াক চিকিৎসায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনার প্রসার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে?
কার্ডিয়াক চিকিৎসায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনা শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। তখন শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কার্ডিয়াক চিকিৎসা দেয়া শুরু করে। পাশাপাশি হার্ট ফাউন্ডেশনও ছিল। ২০০৩ সালের পর থেকে ল্যাবএইড অনেক পূর্ণাঙ্গ পরিসরে কার্ডিয়াক চিকিৎসাসেবা চালু করে। এখানে নিয়মিত সার্জারি, প্রাইমারি এনজিওপ্লাস্টিসহ হৃদরোগের যাবতীয় চিকিৎসা শুরু হয়। ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল চালুর পর বারডেম, ইউনাইটেড, স্কয়ার, এভারকেয়ারের মতো হাসপাতালগুলো কার্ডিয়াক চিকিৎসাসেবা দেয়া শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশে কার্ডিয়াক প্রতিস্থাপন ছাড়া উন্নত বিশ্বে হৃদরোগের যত চিকিৎসা হয়, তার সবই হয়।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কার্ডিয়াক চিকিৎসা হচ্ছে বহুদিন। বর্তমানে এ চিকিৎসার উৎকর্ষ কেমন? চিকিৎসার সক্ষমতা ও রোগীদের সন্তুষ্টি অর্জন হয়েছে কি?
অন্যান্য চিকিৎসার মতোই দেশে কার্ডিয়াক চিকিৎসা শুরু সরকারি ব্যবস্থাপনায়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ চিকিৎসার ব্যাপ্তি অনেক কম। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় এখন বেশির ভাগ চিকিৎসা হয়। আর আমরা যদি মানের দিকে চিন্তা করি তাহলে প্রতিদিনই বেসরকারিতে চিকিৎসার মান বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ইমার্জেন্সি এবং ইনভেসিভ চিকিৎসাসেবা অনেক বেশি দেয়া হয়।
বাংলাদেশে কার্ডিয়াক চিকিৎসার প্রসারের কথা আমরা জানি। কিন্তু ভাসকুলার চিকিৎসার কী অবস্থা?
কার্ডিয়াক ভাসকুলার রোগেরই একটি ধরন। এই করোনারি রোগ ছাড়াও ভাসকুলার রোগ মানবদেহের যেকোনো জায়গায়ই হতে পারে। বাংলাদেশে টোটাল ভাসকুলার চিকিৎসার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, দেশে অসংক্রামক রোগের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ। চিকিৎসার উন্নতি ঘটলেও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ব্যর্থতা রয়েছে কিনা।
এ উপমহাদেশে হৃদরোগ এমনকি উচ্চ রক্তচাপ খুব বেশি ছিল না। তুলনামূলক এদিককার লোকজনের অন্যান্য রোগের চেয়ে কার্ডিয়াক রোগের প্রতিরোধে শারীরিক সক্ষমতা কম। কারণ আমাদের খাদ্যাভ্যাস। এগুলো সবই হৃদরোগের জন্য খুব আকর্ষণীয় একটা ব্যাপার। খাদ্যাভ্যাস কিংবা নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন পরিহার করলে হয়তো রোগটা কমানো যাবে।
বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উৎকর্ষ বাড়লেও বিশেষায়িত সেবাগুলো রাজধানীকেন্দ্রিক। কার্ডিয়াক চিকিৎসার সরকারি ও বেসরকারি সুবিধার ৯০ শতাংশই রাজধানীতে। রাজধানীর বাইরে চিকিৎসার বিস্তার হচ্ছে না কেন?
সরকারিভাবে এনজিওগ্রামসহ কার্ডিয়াক কিছু চিকিৎসা রাজধানীর বাইরে রয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী রাজধানীর বাইরে কার্ডিয়াক চিকিৎসক নেই। চিকিৎসকরাও যেতে চান না। বেসরকারিভাবে একটি কার্ডিয়াক হাসপাতাল স্থাপন, জনবল নিয়োগ ও পরিচালনা অনেক ব্যয়বহুল। খুলনা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় কার্ডিয়াক হাসপাতাল বেসরকারিভাবে হয়েছিল। জনবল ও ব্যয়ের কারণে সেসব প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। একটা কার্ডিয়াক হাসপাতালে দক্ষ লোকবল প্রয়োজন হয়। যেটা না হলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। ১০০ রোগীকে বাঁচিয়ে যদি একজন মারা যায় তাহলে ওই হাসপাতালের টিকে থাকাটাই কঠিন।
গবেষণায় দেখা গেছে, হৃদরোগীর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য যে চিকিৎসা যন্ত্রাংশ ও লোকবল প্রয়োজন তা মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতালে অনুপস্থিত। রোগীকে প্রাথমিকভাবে রোগ নিরীক্ষা করে পরবর্তী সময়ে বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাতে হবে। এমনটি হলে শতভাগ রোগী বাঁচানো সম্ভব। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ হাসপাতালে এলে তাকে রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এনজিওগ্রাম করতে হতে পারে। এজন্য কার্ডিওলজিস্ট লাগবে, এনজিওগ্রাম মেশিন লাগবে। অবকাঠামো থাকতে হবে। এগুলো না থাকলে রোগ নিরীক্ষা সম্ভব নয়। এছাড়া হৃদরোগ নিরীক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। তবে সবগুলোর জন্যও ন্যূনতম দক্ষ লোকবল প্রয়োজন। রোগ নিরীক্ষা করে যখন হৃদরোগ শনাক্ত হবে, তখন চিকিৎসার জন্য দ্রুত বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাতে হবে। দক্ষ লোকবল, যন্ত্রাংশ ও বিনিয়োগের অভাব রয়েছে।
দেশে হৃদরোগ বৃদ্ধির বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? গবেষণার ভিত্তিতে কী জানতে পারছেন?
দেশের মানুষের হৃদরোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে—এটা ঠিক। তবে হৃদরোগ বেড়ে যাওয়ার পেছনে শুধু একটি কারণকে দায়ী করা যাবে না। এর পেছনে আসলে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। জন্মগত কারণে হৃদরোগ হতে পারে। মানুষ ইদানীং যেন নিশ্চল জীবনযাপনের প্রতি অনেকটা আগ্রহ অনুভব করে। কায়িক শ্রম করতে চায় না। নানা কারণে মানুষের দুশ্চিন্তাও যেন বেড়ে গেছে। এছাড়া আমরা রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলোও গ্রহণ করছি না। নিজেদের ভালো রাখতে হলে বছরে ন্যূনতম একবার রোগ পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। আমরা এগুলো করছি না। যখন হার্ট অ্যাটাক হয়, মানুষ কেবল তখনই হাসপাতালে ভর্তি হয়। একটা কথা মনে রাখা দরকার, কায়িক পরিশ্রম, খাদ্যাভ্যাস, ওজন ঠিক রাখা, নিয়মিত চেকআপ, ডাক্তারের পরামর্শ—এসব মানুষকে হৃদরোগ থেকে বিরত রাখে।
বাংলাদেশে একজন মানুষের চিকিৎসা গ্রহণে শতকরা ৭০ শতাংশ ব্যয় নিজের পকেট থেকে করতে হয়। কার্ডিয়াকের সব ধরনের সার্জারি ও চিকিৎসার খরচও বেশি। দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সক্ষমতার মধ্যে এ বিশেষায়িত চিকিৎসা আনতে কী পদক্ষেপ নেয়া যায়?
স্বাস্থ্য বীমা ছাড়া একটি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে না। এটা না করে হঠাৎ চিকিৎসা ব্যয় কমানো কঠিন। কিছু রোগ আছে, যেমন কিডনি, ক্যান্সার, হৃদরোগ—এগুলোর চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। অনেক সময়ই কেবল ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ ব্যয় নির্বাহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। উন্নত দেশে এ রকম ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবীমার সাহায্য পাওয়া যায়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আমাদের দেশেও স্বাস্থ্য বীমা চালু করা যায়। এটা চালু করতে পারলে দেশের সব শ্রেণীর মানুষই চিকিৎসাসেবার আওতায় আসতে পারবে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে এর সফল উদাহরণ রয়েছে। সেখানে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ এর মাধ্যমে প্রায় ২৫-৩০ কোটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
আপনি দীর্ঘদিন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। বিশেষায়িত চিকিৎসা যেমন হৃদরোগে আক্রান্তরা কি দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা রাখতে পারে?
হৃদরোগের ক্ষেত্রে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে। ল্যাবএইড, হার্ট ফাউন্ডেশনসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিশ্বমানের হৃদরোগ চিকিৎসা দিতে সক্ষম। এর ফলে মানুষের মনেও আস্থা জন্ম নিয়েছে। ২০০০ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, হৃদরোগ চিকিৎসায় বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বর্তমানে ৮০ শতাংশই কমে গেছে।
তবু হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরিসংখ্যানও কম নয়। এর কারণ কী?
কেউ হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলে সেটা চিকিৎসকের দ্বিতীয় মতামতের জন্য যায়। কেউ যদি মনে করে, আমি যেহেতু সিঙ্গাপুর যাচ্ছি তাহলে সেকেন্ড অপিনিয়নটা নিয়ে আসি। এটা মানুষ করবে। আগেও এমন ছিল। যেমন কলকাতার লোক বেঙ্গালুরু যাচ্ছে। বেঙ্গালুরুর লোক মুম্বাই যাচ্ছে। আবার মুম্বাইয়ের লোক সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে। মানুষ কিন্তু মাইগ্রেশনে বিশ্বাসী। তাই এ রকম হচ্ছে।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় আস্থা বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আপনার পরামর্শ কী?
প্রথম কথা হলো, ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ দরকার। তাদের এ বিষয়টা উপলব্ধি করতে হবে, রোগীর আস্থা অর্জনটাও চিকিৎসার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা যাতে রোগীর সঙ্গে আন্তরিক হন, ঠিকমতো কাউন্সেলিং করতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেই সঙ্গে জরুরি হচ্ছে চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত সবার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এসব করা গেলেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।
হাসপাতাল পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ করে কার্ডিয়াক হাসপাতাল পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী?
কার্ডিয়াক হাসপাতাল আসলে একটি ইমার্জেন্সি হাসপাতাল। যেখানে এনজিওপ্লাস্টি থেকে শুরু করে সার্জারির মতো জটিল কাজ হয়ে থাকে। হৃদরোগ মানুষের হঠাৎ মৃত্যুর কারণ। তাই এ হাসপাতালে জবাবদিহিতার বিষয়টি কঠোরভাবে থাকা দরকার। একটি সফল কার্ডিয়াক হাসপাতাল পরিচালনায় দক্ষ ও জবাবদিহিতার মানসিকতাসম্পন্ন জনবল, আধুনিক যন্ত্রপাতি, আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো থাকা দরকার।